প্রকাশিত: ০৭/০৮/২০১৮ ৭:৪৭ এএম , আপডেট: ১৬/০৮/২০১৮ ১১:৪২ পিএম

নিউজ ডেস্ক :
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে এবার মুখ খুললেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আমরা বড়রা তাদের (শিক্ষার্থীদের) উপদেশ দেয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা গর্তের ভেতর থাকা মানুষ। গর্তের ভেতরে থেকে উপদেশ দেয়া যায় না। গতকাল সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো ‘তুমিই বাংলাদেশ’ শিরোনামের এক লেখায় তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, দুই সহপাঠীর অপঘাতে মৃত্যুর প্রতিবাদে স্কুলের শিশু-কিশোররা রাস্তায় নেমেছে। রাস্তায় তারা শুধু শোক প্রকাশ করে থেমে থাকেনি। এ রকম শোক যাতে ভবিষ্যতে কাউকে করতে না হয়, তার জন্য ব্যবস্থা চায় তারা। তারা নিরাপদ সড়ক চায়। সড়ক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তারা প্রশাসনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছে। তারা নিজেরা এই ব্যবস্থাপনায় নেমে দেখাতে চেয়েছে যে, আইনের প্রয়োগের অভাবেই মূলত সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তারা বাংলাদেশের মূল রোগটাকে সবার সামনে নিয়ে এসেছে। তারা আইনের প্রয়োগ চায়। যে প্রয়োগের নমুনা দেখানোর জন্য তারা গাড়িচালকের লাইসেন্সের পেছনে লেগেছে। ফিটনেস সার্টিফিকেটের সন্ধানে লেগেছে। আইনের প্রয়োগ করা যে সহজ বিষয় এবং সমাজে সবার সমর্থন পাওয়ার বিষয়, সেটাও তারা দেখিয়ে দিল। যারা আইনের প্রয়োগকারী তারা নিজেরাই যে আইন মানছে না সেটাও তারা দেখিয়ে দিল। তা-ও কোনো বাহাদুরি করার জন্য নয়। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য।

তাদের শৃঙ্খলা দেখে হতবাক হয়েছি। প্রগাঢ় পরিপক্বতার চিহ্ন সর্বত্র। বিভিন্ন স্থানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখা প্ল্যাকার্ডগুলো ইতিহাসে স্থান পাওয়ার মতো। তারা ম্যানেজমেন্ট থিওরির মূল প্রতিপাদ্যকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে সুশৃঙ্খলভাবে তাদের কাজ নিয়ে এগিয়ে গেছে নিজ নিজ উদ্যোগে। তারা কোনো কমান্ড-কাঠামো তৈরি করেনি, কোনো কমিউনিকেশন চ্যানেল স্থাপন করেনি, কোনো প্রশিক্ষণের অপেক্ষায় থাকেনি, নীতিমালা তৈরির প্রয়োজন বোধ করেনি, কোনো কনসালট্যান্টের শরণাপন্ন হয়নি। তারা তাদের মতো করে সুশৃঙ্খলভাবে এক মনে কাজ করে গেছে।

সরকার তার সব বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এখন শিশু-কিশোরদের হাত থেকে রাজপথ মুক্ত করার কাজে লেগেছে। সরকার একটা বিরাট সুযোগ হাতছাড়া করে ফেলল। রাজপথ মুক্তির অভিযানে না গিয়ে সরকার সুন্দরভাবে শিশু-কিশোরদের, তাদের বাবা-মায়েদের, দেশের সব মানুষের ক্ষোভ মুক্তির কাজে নামলে রাজপথও মুক্ত হতো, শিক্ষার্থীরাসহ সব মানুষের বাহবা পেত। লাইসেন্সবিহীন চালক এবং ফিটনেস সার্টিফিকেটবিহীন গাড়ি চিহ্নিত করা কি এতই কঠিন কাজ?

রাস্তায় নামা শিশু-কিশোরদের দেখে সবাই অভিভূত হয়েছে। তারা কান্নাকাটি করার জন্য বা শোকের মাতম করার জন্য রাস্তায় নামেনি। অত্যন্ত পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে তারা সমাধান নিয়ে নেমেছে। সুশৃঙ্খলতার সঙ্গে তারা কাজ করে গেছে। শিশুদের যেখানেই যে কাজে দেখেছি মনে হয়েছে যেন একজন প্রশিক্ষিত দক্ষ কর্মকর্তা তার দায়িত্ব পালন করেছে। তার হাতে কোনো ওয়াকিটকি নেই। অস্ত্র নেই। মেরুদণ্ডহীন অস্তিত্বের পরিবেশে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্ম বুঝিয়ে দিয়েছে- আমাদের মেরুদণ্ড আসলে হারিয়ে যায়নি।

ড. ইউনূস বলেছেন, শিশু-কিশোরদের রাস্তায় নামার পর থেকে আমার কাছে নানাজনে অনুরোধ পাঠাচ্ছে তাদের উদ্দেশে কিছু বলুন, কিছু উপদেশ দিন, তাদের দিকনির্দেশনা দিন। আমি তাদের দিকে তাকালে বুঝে উঠতে পারি না কী উপদেশ দেব? পরে বুঝতে পারলাম, আমরা বড়রা তাদের উপদেশ দেয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা গর্তের ভেতর থাকা মানুষ। তবে তাদের প্রতি আমার একটাই পরামর্শ। তোমরা আমাদের উপদেশ শুনবে না। তোমরা আমাদের উপদেশ দেয়ার সুযোগ দিও না। যদি একবার এ সুযোগ দাও তাহলে তোমাদের টেনেহিঁচড়ে আমাদের গর্তে না ঢোকানো পর্যন্ত আমরা আর থামব না।

তোমরা আমাদের মতো স্বেচ্ছা-অন্ধের কথায় কর্ণপাত করো না। কর্ণপাত করো না বলেই তোমরা রাস্তার দায়িত্ব নিতে পেরেছ। যারা নিজেরা পথ চেনে না, তারা পথ দেখাবে কী করে। আমাদের পরামর্শ নিলে তোমরাও গর্ত বানানোর কাজে লেগে যেতে।

শিশুদের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন, তোমরা প্ল্যাকার্ডে অত্যন্ত সুন্দর করে তোমাদের সব কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছ। তুমি বলেছ, ‘তুমি বাংলাদেশ।’ সেটাই সবচেয়ে খাঁটি কথা। অন্য কোনো বাংলাদেশকে তুমি স্বীকার করো না। তোমার মতো করে তুমি তোমার বাংলাদেশকে বানিয়ে নাও। তুমি বলেছ : ‘তুমি যদি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, তুমি যদি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ।’ তুমি বলেছ : ‘আমরা যদি না-জাগি মা, কেমনে সকাল হবে।’ তোমরা জেগেছ, এবার সকাল হবে। আমরা যারা চোখে দেখেও দেখি না তাদের চোখের পর্দা এই ভোরের জ্বলন্ত আলো দিয়ে কেটে দাও। আমাদেরকে তোমাদের সঙ্গে থাকার উপযুক্ত করে নাও। তুমি যেমন বাংলাদেশ, আমাকে তোমার মতো করে বাংলাদেশ হওয়ার মতো উপযুক্ত করে নাও।

গর্তে গুঁজে থাকা আমাদের শীতল নিস্তেজ শরীরে তোমরা আগুন ছড়িয়ে দাও। যদি আগুনের কোনো ছিটেফোঁটা আমাদের শরীরে এবং মনে এখনো থেকে থাকে, তবে হয়তো তোমার আগুনে সেটা আবার উত্তাপ ফিরে পাবে। তোমরাই পারবে আমাদের হিমশীতল অস্তিত্ব থেকে টগবগে বাংলাদেশকে বের করে আনতে। তুমিই বাংলাদেশ। তোমার চোখেই দেখতে চাই বাংলাদেশকে। তোমার মনের রং মেখে রাঙিয়ে দিতে চাই আমাদের মনগুলোকে।

পাঠকের মতামত

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সীমান্তরক্ষীদের নিতে জাহাজ আসবে এ সপ্তাহেই

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসা দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যদের ফের ...